ঢাকা, সোমবার   ২১ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

এক পায়ে পরীক্ষা দিচ্ছে হার না মানা তামান্না  

প্রকাশিত : ১৬:৩৪, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | আপডেট: ১৬:৩৬, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

Ekushey Television Ltd.

দুই হাত নেই। পা-ও নেই একটি। বাকি একটি মাত্র পা-ই তার চলার সম্বল। আর সেই এক পায়ে পরীক্ষা দিচ্ছে হার না মানা তামান্না। প্রথম দিনের পরীক্ষায় অন্যদের মতো অংশ নিয়েছে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া ইউনিয়নের আলিপুর গ্রামের রওশন আলীর মেয়ে তামান্না নূরা। তবে সারাদেশের লাখো পরীক্ষার্থীর চেয়ে একেবারেই ব্যতিক্রম তামান্না। জন্মগতভাবে হাত ছাড়া মাত্র একটি পা নিয়েই দুনিয়ার আলো দেখে সে। তবে ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার প্রতি অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণে হার মানতে বসেছে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা। কেউ মমতায়, কেউ বা করুণার চোখে তাকায়। কিন্তু এসবে ভ্রুক্ষেপ নেই মেয়েটির। তার দৃষ্টি অনেক দূরে, শিক্ষার সর্বোচ্চ শিখরে। পা-ই এখন তার ‘স্বপ্নপূরণের হাতিয়ার’।      

জানা যায়, চলতি এসএসসি পরীক্ষায় ঝিকরগাছার বাঁকড়া জে কে হাই স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে তামান্না। স্থানীয় বাঁকড়া ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসেই পরীক্ষা দিচ্ছে সে। পরিবার, শিক্ষক, সহপাঠীদের ধারণা, প্রাথমিক বৃত্তি ও জেএসসি’র ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এসএসসিতেও ভালো ফলাফল করবে তামান্না।    

তামান্নার শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে তামান্না কেজি, প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণির প্রতিটি ফলাফলে মেধাতালিকায় প্রথম হয়েছে। পাশাপাশি ‘এডাস বৃত্তি পরীক্ষায়’ প্রতিবছরই বৃত্তি পেয়েছে। এছাড়াও ২০১৩ সালে পিইসি এবং ২০১৬ সালে জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে তামান্না। এক পায়ে ছবিও আঁকে সে। এর পেছনের গল্প মা-বাবার মরিয়া চেষ্টা, আর নিজের অদম্য ইচ্ছা।

তামান্নার বাবা রওশন আলী সাংবাদিকদের বলেন, প্রতিবন্ধী মেয়ে জন্ম নেওয়ার খবর পেয়ে বিদেশের চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে আসি। মেয়েকে যত্নের সঙ্গে বড় করে তোলার ইচ্ছায়। জন্মের পর থেকে অর্থাভাবের পাশাপাশি সামাজিকভাবে অনেক প্রতিকূলতার মোকাবেলা করতে হয়েছে তার মেয়েকে। তবে কখনো আমরা ভেঙে পড়িনি। সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা করেই তামান্নার মা খাদিজা পারভীন শিল্পী তাকে একটি পায়ের উপর ভর করে সব ধরনের শিক্ষা দিতে থাকে। তামান্না অক্ষরজ্ঞান তার মায়ের কাছ থেকেই শেখে। সে সময় বাড়ি থেকে দূরের ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও নিয়মিত স্কুলে পাঠানো আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাই স্থানীয় আজমাইন এডাস স্কুলে তাকে নার্সারিতে ভর্তি করানো হয়। তামান্নার শ্রবণ ও মেধাশক্তি এতো ভালো ছিল যে একবার শুনলে বিষয়টি সে দ্রুত আয়ত্ব করতে পারতো।

তামান্নার বাবা রওশন আলী জানান, সামান্য কিছু জমি থেকে আসা আয়েই চলে তাঁর সংসার। সম্প্রতি তিনি চাকরি নিয়েছেন একটি নন এমপিও মাদ্রাসায়। সেখান থেকে কোনো বেতন পান না। তাই ঠিকমতো সংসার চালানোই দায়। তাঁর সামর্থ্যের মধ্যে আগামীতে আর কতটুকুই করতে পারবেন তামান্নার জন্য এই চিন্তায় দিশেহারা তিনিও। মেয়ের জন্য মুখ ফুটে সহায়তা চাইতেও পারেন না এই শিক্ষক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হবে তাও জানেন না।

তামান্নার মা খাদিজা পারভীন জানান, প্রথমে তাকে এলাকার একটি স্কুলও ভর্তি নিতে চায়নি। তাতে তারা থেমে যাননি। অক্ষর লেখা, পায়ের আঙুলের ফাঁকে চক ধরিয়ে লেখা, তারপর কলম ধরিয়ে লেখা আয়ত্ব করে সে। ধীরে ধীরে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টানো, পায়ের আঙুলের ফাঁকে চিরুনি, চামচ দিয়ে খাওয়া, চুল আঁচড়ানো সবই সে আয়ত্ব করে ফেলে। তার দক্ষতা সবার নজরে আসে। যখন তাকে ভর্তি করতে চায়নি, তখন এগিয়ে আসে স্থানীয় আজমাইন এডাস স্কুল কর্তৃপক্ষ। তারা সানন্দে মেয়েটিকে ভর্তি করে নেয়। এরপর থেকে হুইল চেয়ারে করে তামান্নাকে স্কুলে আনা-নেওয়া করেন তার বাবা। এ কাজে কখনো কখনো তামান্নার স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী অথবা প্রতিবেশীরাও সহায়তা করেন। আজমাইন স্কুলের পর তামান্নার বর্তমান স্কুল জোনাব আলী খান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও তামান্নাকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন।

তামান্না নূরা জানান, ভালো প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছি। সবার কাছে দোয়া প্রার্থনা করে তামান্না বলেন, আমার জন্য দোয়া করবেন যেন ভালো ফলাফল করতে পারি। পাশাপাশি সব শিক্ষক, বাবা-মা, সহপাঠী সবার কাছেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে তামান্না।

তামান্না আরো জানায়, তার খুব ইচ্ছা মেডিসিন বিষয়ে চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু সে জানে না শারীরিক অসুবিধার কারণে তা সম্ভব হবে কি না। তার ইচ্ছা, যদি শারীরিক কারণে মেডিক্যালে পড়া না যায়, তা হলেও উচ্চশিক্ষার জন্য ভালো পড়াশুনা করতে এসএসসির পর যেন সে শহরে যেতে পারে। ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হবে এই চিন্তায় মাঝে মধ্যেই হতাশ হয়ে পড়ে মেধাবী মেয়েটি।

তামান্নার স্কুলের প্রধান শিক্ষক হেলাল উদ্দিন খান জানালেন, ভর্তির পর থেকে তামান্নার জন্য স্কুলের সেশন ফিসহ অন্যান্য সব ফি মওকুফ করা হয়েছে। শুধু প্রতিবন্ধী ভাতা ছাড়া সরকারি আর কোনো সহায়তা সে পায়নি। তাই তার আগামী দিনের পড়াশুনা এগিয়ে নিতে সরকারি-বেসরকারি সহায়তা কামনা করেন তিনি।  

এসি

  


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি